ওয়েবসাইট খুলে প্রতারণার অভিযোগ: হতাশায় ২৩ হাজার গ্রাহক

ডেইলিইউকেবাংলা নিউজ,সিরাজগঞ্জঃ সহজলভ্যতা আর প্রয়োজনের কারণে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল এখন সবার হাতে-হাতে। আর এই সুযোগে সাধারণ মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে সিরাজগঞ্জে আউটসোর্সিং ব্যবসা ‘টাচ আর্ন’ নামে একটি ওয়েবসাইটের উদ্যোক্তারা ডিজিটাল প্রতারণা করে গ্রাহকের প্রায় ২০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এজন্য এর সাথে জড়িত প্রায় ২৩ হাজার গ্রাহক এখন হতাশায় নিমজ্জিত। সবাই বিনিয়োগের টাকা ফেরত পেতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, কিছু দিন আগেও মোবাইল ফোনে এই ওয়েবসাইটে ছয় হাজার চারশ’ টাকায় আইডি খুলে প্রতিদিন ৭/৮ মিনিট কাজ করেই আয় করতে পারতো দুই ডলার পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা। তাই বিষয়টি স্কুল, কলেজ পড়ুয়া বেকার যুবকদের মতো টাকা আয়ের এই সহজ পথে হেঁটেছিল সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর ও বেলকুচি থানা সহ অন্যান্য জেলার মানুষরা। প্রথম দিকে কৌশলী প্রতারক চক্র ডলার আয়ের লোক দেখানো সুবিধা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও হঠাৎ গ্রাহকের আমানতের টাকা নিয়ে গত ৯ মে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে পালিয়েছে। এরপর থেকে প্রতারিত গ্রাহকরা পাঁচ উদ্যোক্তা সহ তাদের অর্ধশতাধিক সহযোগীদের আর খুঁজে পাচ্ছে না। তবে পুলিশ বলেছে গণপ্রতারিত সরলপ্রাণ মানুষগুলো অভিযোগ দিলেই নেবে যথাযথ ব্যবস্থা।

বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে বেলকুচি অনার্স কলেজের ছাত্র রণি তালুকদারের আশা ছিল লেখা পড়ার পাশাপাশি বাড়তি আয় করে নিজের খরচ মিটিয়ে পরিবারকে সাহায্য করা। তখন প্রতারক মোবারক হোসেনের পরামর্শে আউট সোর্সিং ‘টাচ আর্ন’ এ নির্ধারিত টাকায় আইডি খুলে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন তাতে সুবিধা মেলায় পরে বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা ৯৬ হাজার টাকায় আরো আইডি খোলেন রণি। তবে হঠাৎ করে ওয়েবসাইটটি গত ৯ মে বন্ধ হয়ে যায়। প্রতারক মোবারক হোসেন ও তার সহযোগীরাও বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। এরপরই তার স্বপ্নে দেখা দেয় কালো মেঘ। দেনাকৃত টাকা পরিশোধে মাথায় পড়ে হাত। এখন ঋণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। তার মতো এমনি অবস্থা এনায়েতপুর থানার গোপিনাথপুর গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছাত্র রবিউল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন, ১০ম শ্রেণির ছাত্র শামীম হোসেন, তাঁত শ্রমিক ইব্রাহীম হোসেন, খোকশাবাড়ি গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র শরিফুল ইসলাম, রূপসী গ্রামের আব্দুল কাদের, শিবপুরের শাহীন, গোপালপুরের আলী আকবার সহ হাজার-হাজার তরুণের। তাদের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল www.touchea.org এই ওয়েবসাইটে। ছয় হাজার চারশ’ টাকায় আইডি খুলে ৭/৮ মিনিট অ্যান্ড্রোয়েড মোবাইলে তাতে কিছু বিজ্ঞাপন চিত্র দেখলেই দৈনিক দুই ডলার করে নিজের আইডিতে জমা হতো। আর এভাবে তা ২৫ ডলারে পরিণত হলে এর সমপরিমাণ টাকা প্রতারকরা দিয়ে দিত। প্রথম দিকে লেনদেন যথা নিয়মে চললেও হঠাৎ করে গত ৯ মে তা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ২৩ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া ২০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেয় ওয়েব সাইটটির ছয়জন শীর্ষ কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জ জেলার প্রতারিত হওয়া গ্রাহকরা গতকাল এনায়েতপুর ইসলামীয়া উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে পাওনা টাকা ফেরত ও দোষীদের শাস্তির দাবীতে একটি সমাবেশ করে। সমাবেশে এনায়েতপুর, বেলকুচি, সিরাজগঞ্জ সদর থানার দুই শতাধিক প্রতারণার শিকার ছাত্র/শিক্ষক, শ্রমিকেরা অংশ নেয়। তারা অভিযোগ করে জানান, এনায়েতপুরে অবস্থিত খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইএস বিভাগের ছাত্র বেলকুচির মিটুয়ানী গ্রামের শাহাবুদ্দিনের ছেলে আব্দুল আলীম তীব্র (২৩), একই বিভাগে অধ্যয়নরত একই গ্রামের বেলাল মেকারের ছেলে সুজন রেজা (২৪), তফাজ্জল হোসেনের ছেলে তোফায়েল হোসেন (২২), মোবারক হোসেন (২২) এবং উল্লাপাড়ার ইমরান শেখ (২৮) মিলে ওয়েবসাইটটি বানিয়ে কৌশলে ছাত্র/ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এতে আইডি করে দেয়। তারা লোভ দেখায় উল্লেখিত টাকায় কথিত সিঙ্গাপুরি ওয়েবসাইটে আইডি করলে মাসে খুব সামান্য কাজ করে কমপক্ষে তিন হাজার ৯শ’ টাকা আয় সম্ভব। কয়েক মাস তা যথা নিয়মে চললে বিষয়টি সমগ্র জেলা তথা দেশ জুড়ে তাদের অর্ধশতাধিক সহযোগীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।গ্রাহক বেড়ে তা প্রায় ২৩ হাজারে পরিণত হয়। এনায়েতপুর থেকে পরিচালিত কথিত ওয়েবসাইটটি এসব সরলপ্রাণ গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় প্রায় ২০ কোটি টাকা।

হঠাৎ করেই গত ৯ মে গ্রাহকদের সাথে কোন কথা না বলে প্রতারক আলীম, সুজন রেজা, তোফায়েল, মোবারক, ইমরান ও তাদের সহযোগীরা আমানতের ২০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এদের সহযোগী খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক তাহেরুল আলম, একই বিভাগের ছাত্র বেলকুচির সরাতৈল গ্রামের কামাল হোসেন, এনায়েতপুর থানার রূপসী গ্রামের রুবেল হোসেন, আলতাফ মাস্টারের ছেলে আসিফ হোসেন, আতিক হোসেন, গ্রামের ইমরান হোসেন, এনায়েতপুর গ্রামের ব্লক জহুরুলের ছেলে রিমন হোসেন, তামাইয়ের আলামিন হোসেন, বেলকুচির সুবর্ণসাড়া সাড়ার রেজা, মিটুয়ানীর ফিরোজ হোসেন, বেতিলের আব্দুস ছালাম, একই বিভাগের ছাত্রী মারিয়া খাতুন, বিবিএ’র ছাত্রী বিতু। এরা সবাই খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত অবস্থায় এই ওয়েবসাইটের অবৈধ ব্যবসার সাথে পুরোপুরি নিয়োজিত থেকে হাজার-হাজার গ্রাহক সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিল। এরা সবাই এখন গা ঢাকা দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতারণার শিকার এনায়েতপুর থানার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামের শাহীন খন্দকার, বাক্ষ্মণগ্রামের আলামিন, খোকশাবাড়ির শরিফুল ইসলাম, বেলকুচির বিশ্বাসবাড়ির সিফাত হোসেন।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি গ্রামের আমানুল্লাহ জায়ের জানান, আমরা সরলভাবে প্রতারণার সাথে জড়িত হয়েছি। তাদের কৌশলী কথায় আমরা সরল মনে বিশ্বাস করে আজ আমরা ২৩ হাজার গ্রাহক প্রতারিত। তাদের ওয়েবসাইটটি নিজেদেরই বানানো। তারা নিজেরাই পরিচালনা করে আমাদের কাছ থেকে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। তাদের বাড়িতে গিয়েও কাউকে আমরা পাচ্ছি না। এ অবস্থায় সরকারের কাছে আমরা বিনিয়োগের টাকা উদ্ধারে সাহায্য ও দোষী সকলকে আটক করে শাস্তির আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে এনায়েতপুর খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই প্রতারকদের বেশির ভাগদেরই বাড়ি বেলকুচি উপজেলার মিটুয়ানী গ্রামে। সরজমিনে প্রতারক মোবারক হোসেন এবং আব্দুল আলীমের বাড়িতে গেলে তাদের পরিবার সহ কাউকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে স্থানীয় সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, বিষয়টি আসলেই হতাশাজনক। এভাবে গণমানুষের সাথে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা চক্রটি হাতিয়ে নেবে তা কেউ কখনো কল্পনাই করেনি। এদের অবশ্যই কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ।বিষয়টি নিয়ে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহীনুর আলম জানান, আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অতোটা অবিহিত নই। তবে কেউ অভিযোগ দিলে খুবই গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র:ইত্তেফাক

Leave a Reply

Developed by: TechLoge

x