সত্যবাণীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সেমিনার: সত্য লুকিয়ে থাকলে অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে

ডেইলিইউকেবাংলাডটকমঃ ‘ক্ষমতার মুখোমুখি হয়েও সত্য বলা উচিত, কারন সত্য লুকিয়ে থাকলে সমাজ চলে যায় অবিচারের দখলে, অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে’।

সত্যবাণী’র দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিশেষ সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এমন মন্তব্য করা হয় বুধবার।

৬ই মার্চ বিকেলে লন্ডনের কুইনমেরী ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে  প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। আনুষ্ঠানিক ভাবে কেইক কেটে সত্যবাণীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন হাই কমিশনার।

সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক আবু মুসা হাসানের সঞ্চালনায় ‘জার্নালিজম ইন টুডেইজ ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উত্তাপন করেন প্রবীন সাংবাদিক, বাংলাদেশের ইংরেজী জাতীয় দৈনিক ‘এশিয়ান এইজ’ এর এডিটর-ইন-চার্য  সৈয়দ বদরুল আহসান। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিবিসি’র  সাবেক সাংবাদিক, এশিয়ান এফেয়ার্স এর সম্পাদক ডানকান বার্টলেট, কমনওয়েলথ জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সহসভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা ও সত্যবাণীর এডিটর-এট-লার্জ মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হাই কমিশনের মিনিষ্টার প্রেস আশিকুন্নবী চৌধুরী, ব্রিটিশ অভিনেতা ও লেখক সেবাস্টিয়ান ডান ও লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমদাদুল হক চৌধুরী।

বক্তব্য রাখেন, কুইনমেরী ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সভাপতি আহমেদ মাহবুব, সত্যবাণীর প্রধান সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা ও কন্ট্রিবিউটিং এডিটর আনসার আহমেদ উল্লা।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো ব্রিটিশ সোসাইটিতে তুলে ধরার আহবান জানিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হাই কমিশনার মুনা তাসনিম বলেন, সংবাদ মাধ্যম হলো সমাজের চোখ। এই চোখ সমাজে ঘটে যাওয়া ইতিবাচক ও নেতিবাচক সব ঘটনাগুলোই দেখবে এমন প্রত্যাশা থাকে সকলের। অর্জন ও সাফল্যের গল্পগুলো নতুন সাফল্য অর্জনে অনুপ্রেরণা জোগায়, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো এমনি কিছু গল্প যা  শুনলে বাংলাদেশী ব্রিটিশরা যেমন গর্ব বোধ করবে, ঠিক তেমনি তা থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে গ্লোবাল সোসাইটির অনেকেই। ব্রিটিশ মূলধারায় এই সাফল্য গল্পগুলোর বিস্তৃতি ঘটাতে পারে ব্রিটেনের বাংলা সংবাদ মাধ্যমগুলো।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের যুগান্তকারী সাফল্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে মুনা তাসনিম বলেন, একটি প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মানে এই অর্জন একটি মাইল ফলক। ব্রিটেনে হাই কমিশনার হিসেবে নিজের যোগদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ সংগ্রামের সাফল্যের কারনেই। বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন গ্লোবাল এক্সট্রিমিজমের বিরুদ্ধে এক কঠোর বার্তা বলেও মন্তব্য করেন হাই কমিশনার।

নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী ব্রিটিশদের সাথে শিকড় বন্ধন আরো সুদৃঢ় করতে বাংলা সংবাদ মাধ্যমগুলোর আরও সক্রিয় ভূমিকা আশা করে হাই কমিশনার বলেন, এক্ষেত্রে দ্বিভাষিক সত্যবাণীর ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। সত্যবাণী অনলাইনটি নিয়মিতই ভিজিট করেন, এমনটি জানিয়ে মুনা তাসনিম বলেন, দেশের খবর ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশীদের কাছে পৌছে দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশী ব্রিটিশ নতুন প্রজন্মের একটি সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা রাখছে সত্যবাণী।

‘জার্নালিজম ইন টুডেইজ ওয়ার্ল্ড’ তাঁর জন্য একটি কঠিন আলোচনার বিষয়, এমন মন্তব্য করলেও এনিয়েও আলোচনা করেন হাই কমিশনার। তিনি বলেন, আজকের এই অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সংবাদ হয়ে উঠছে সম্পাদনা বিহীন, সোস্যাল মিডিয়ার অসম্পাদিত  সংবাদ নৈতিক সাংবাদিকতার জন্য হয়ে উঠেছে চ্যালেঞ্জ।

বক্তব্য রাখছেন (বা থেকে) সৈয়দ নাহাস পাশা, ইমদাদুল হক চৌধুরী ও সৈয়দ আনাস পাশা।

সংবাদপত্র প্রকাশনার আর্থিক ঝুঁকি এড়াতে অনলাইন মাধ্যমকে একটি স্মার্ট পরিকল্পনা আখ্যায়িত করে হাই কমিশনার বলেন, তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন নৈতিক সাংবাদিকতা ও সম্পাদকীয় নীতি। সংবাদ প্রকাশে সত্যবাণী এ দুটো বিষয় গুরুত্ব দিচ্ছে, এমন মতামত দেন হাই কমিশনার।

সংবাদপত্র ইন্ডাষ্ট্রির আর্থিক ঝুঁকি সম্পর্কে বলতে গিয়ে হাই কমিশনার বলেন, এক সময় বিজ্ঞাপন আয়ের পুরোটাই যেখানে সংবাদমাধ্যমের তহবিলে জমা হতো সেটি এখন আর হয়না। বিজ্ঞাপনের প্রতি ডলারের ৯০ পেন্সই এখন চলে যায় গুগল ও ফেইসবুক একাউন্টে। এক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলা করে ঠিকে থাকার এই দিনে প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে অনলাইন মিডিয়া স্মার্ট পরিকল্পনা।

ডানকান বার্টলেটের প্রেজেন্টেশন।

বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ৩২টি টিভি চ্যানেলের অবাধ টকশো প্রচারণার উল্লেখ করেন হাই কমিশনার। তিনি বলেন ২০০১ সালে বাংলাদেশে যেখানে মাত্র ১টি বেসরকারী টিভি চ্যানেল ছিলো, সেখানে আজ তাঁর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৩২টি। প্রতিটি চ্যানেলই সকাল, দুপুর, বিকেলে প্রচার করছে বিভিন্ন টকশো। এইসব টকশোতে সরকারের অবাধ সমালোচনাসহ সব বিষয়েই স্বাধীনভাবে মতামত দিচ্ছেন আলোচকরা।

মূল প্রবন্ধে সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, আজকের দিনের সাংবাদিকতায় যেমন উত্তেজনা আছে, ঠিক তেমনি আছে চ্যালেঞ্জ ও ঝুকি। সাংবাদিকদের জন্য সাম্প্রতিক সময়টি বিপদজনক, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন,  সাংবাদিকতাকে এখন আমরা যেভাবেই দেখিনা কেন বর্তমান সময়ে এই পেশাটি যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে এর আগে অতীতে কখনই এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। আজকের দিনের গণতন্ত্র, জবাবদিহীতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপক প্রচারণার এই সময়েও সাংবাদিকরা আক্রমনের শিকার হচ্ছেন বেশী। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ‘মনে রাখতে হবে আমরা এমন এক সময়ে ইতিহাসের এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছি, যে সময়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা মূলত সরকার এবং সমাজ পরিচালনা করে’।

প্রবন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের উপর হামলার উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়, এরপরও ক্ষমতার মুখোমুখি দাড়িয়েও আমাদের সত্য বলতে হবে, কারন সত্য লুকিয়ে থাকলে সমাজ পুরোপুরি চলে যাবে অবিচারের দখলে।

মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনা করতে গিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে স্ক্রীন প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন ব্রিটিশ জার্নালিষ্ট ডানকান বার্টলেট। জার্নালিজমের উৎপত্তি ও আজকের দুনিয়ার মডার্ন জার্নালিজম স্থান পায় তাঁর এই পাওয়ার প্রেজেন্টেশনে। একই সাথে বিশ্ব জার্নালিজমের সাথে বাংলাদেশে তার ভ্রমণ এবং আজকের ব্রিটেনসহ সারা বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় তুলা ব্রিটিশ বাংলাদেশি আইএস জিহাদি বউ শামীমা বেগমের ছবি সহ উপস্থাপনা এবং প্রসঙ্গ টেনে চট্রগ্রামে বিমান হাইজ্যাকে একজন নিহত হওয়ার বিষয়ও ছবি সহ তুলে ধরেন তিনি। প্রেজেন্টেশনে তাকে সহযোগিতা করেন অভিনেতা সেভাস্টিয়ান ডান ও সত্যবাণীর ইয়ুথ করেসপন্ডেন্ট নাহিয়ান পাশা।

অপর দুই প্যানেল আলোচক সৈয়দ নাহাস পাশা, মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার এবং অতিথি ইমদাদুল হক চৌধুরী ও সাবেস্টিয়ান ডানও মূল প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন। সাংবাদিকতার অতীত ও বর্তমান বিষয় আলোচনায় নিয়ে আসেন তারা। সাংবাদিকতায় আজকের দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাষ্ট্র, সমাজ ও সংবাদকর্মী সকলের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা আশা করে তারা বলেন, স্বাধীন ও নৈতিক সাংবাদিকতার অনুপস্থিতি একটি সমাজের জন্য ভয়ানক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। তারা সাংবাদিকতার নেতিবাচক দিক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে ব্রিটেন এবং দেশে অসংখ্য অনলাইনের কপি পেইষ্ট সাংবাদিকতা নিয়ে, সেই সাথে ব্রিটেনের বাংলা সংবাদ জগতে ও সংবাদ পত্রে বিজ্ঞাপন ও আর্থিক অপ্রতুলতার বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেন।

মিনিষ্টার প্রেস আশিকুন্নবী চৌধুরী অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদনাহীন অবাধ তথ্য প্রবাহের কথা উল্লেখ করে এক্ষেত্রে সত্যবাণীর প্রশংসা করেন তাঁর বক্তৃতায়। তিনি বলেন আমি নিয়মিতই ভিজিট করি সত্যবাণী। এই অনলাইনটির নিউজ দেখলেই বুঝা যায় প্রফেশনাল সাংবদিকদের একটি গ্রুপ পরিচালনা করছে এটি। সম্পাদনা, নৈতিক সাংবাদিকতা ও তাৎক্ষনিক সংবাদ প্রচার এই প্রতিটি গুনই আছে সত্যবাণীর।

অভিনেতা সেভাষ্টিয়ান তার লিখিত বক্তব্যে আনসার আহমদ উল্লাহ ও  সৈয়দ আনাস পাশাসহ ডানকান বার্টলেটকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ ভ্রমনের স্মৃতি রোমন্থন করে বেশ নাটকীয়ভাবে তার মা, স্ত্রী, মেয়ে এবং দাদীর সাথে তাদের ছোট বেলার বেড শিট পরিবর্তনের কাহিনী, তার মায়ের নির্দেশ কিভাবে তাদের কাছে মনে হয়েছিলো ইত্যাদি বিষয়গুলো বেশ নাটকীয়তার সাথে তুলে এনে আজকের সংবাদ জগতের রেডিও, টিভি, অনলাইন, প্রিন্ট মিডিয়াকে এক চমৎকার ফ্রেমে নিয়ে আসেন, যা দর্শক হ্নদয়ে দাগ কাটে।

অনুষ্ঠানের শেষে ছিলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। এতে অংশ নেন সাংবাদিক উর্মী মাজহার, নিয়াজ আহমেদ, ডা: জাকি রেজওয়ানা, আব্দুল কাদির চৌধুরী মুরাদ এবং কাউন্সিলার শামসিয়া আলী ও ইমরান আহমেদ প্রমূখ। প্রশ্নের জবাব দেন আবু মুসা হাসান, সৈয়দ বদরুল আহসান, ডানকান বার্টলেট, সৈয়দ নাহাস পাশা ও ইমদাদুল হক চৌধুরী।

Leave a Reply

More News from কমিউনিটি

More News

Developed by: TechLoge

x