ভারতে ইভাঙ্কা ট্রাম্পের দামী পোশাক তৈরির কারখানায় শ্রমিক শোষণের অভিযোগ
আন্তর্জাতিকঃ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়ে এবং হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ইভাঙ্কা ট্রাম্প, ভারতের হায়দ্রাবাদে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পোদ্যোগী সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন। তবে সেখানে তাকে তাড়া করেছে এক অন্য ধরনের বিতর্ক।
ইভাঙ্কা ট্রাম্প যেসব দামী পোশাক পরেন এবং যে ফ্যাশন সংস্থার পোশাক ব্যবহার করেন, সেই সব দামী পোশাকের অনেকটাই ভারতে তৈরি বলে ধারণা করা হয়- কিন্তু সেই সব পোশাকের কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার কতটা সুরক্ষিত তা নিয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প ব্র্যান্ড বা হোয়াইট হাউস কোনো জবাব দিতে অস্বীকার করেছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা জানাচ্ছে, বিশ্বের প্রায় পঁচিশটি শ্রম-অধিকার সংগঠন তাদের কাছে এই সফরের প্রাক্কালে চিঠি লিখেও কোনো জবাব পায়নি, অন্য দিকে ট্রেড ইউনিয়নগুলির অভিযোগ ভারতে পোশাক শ্রমিকদের শোষণ চলছে বিরামহীনভাবে।
হায়দরাবাদে মঙ্গলবার গ্লোবাল অন্ট্রেপ্রোনিওরশিপ সামিটে তার ভাষণে ইভাঙ্কা ট্রাম্প নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন শিল্পোদ্যোগী হিসেবে নারীরা কতটা সম্ভাবনাময়।
প্রধানমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদিকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতে শ্রমশক্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য যদি অর্ধেকও কমানো যায়, তাহলে তিন বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে দেড়শো কোটি ডলার প্রবৃদ্ধি হবে।
কিন্তু সমালোচকরা প্রশ্ন তুলছেন, ইভাঙ্কা নিজে যেসব ফ্যাশন সামগ্রী ব্যবহার করেন, সেগুলো তৈরি করে যেসব কোম্পানি সেখানে নারী শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু?
লন্ডন-ভিত্তিক এথিক্যাল ট্রেড ইনিশিয়েটিভ বা ইটিআই ভারতে পোশাক-শ্রমিকদের নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছে, তাদের মতে সেই পরিবেশ কিছুতেই ইভাঙ্কা ট্রাম্পকে স্বস্তি দেবে না।
ইটিআইয়ের গবেষক মার্টিন বাটল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সবাইকে একধাঁচে ফেলা না-গেলেও সার্বিকভাবে ভারতের পোশাক খাতে কাজের পরিবেশ খুব খারাপ, বিরাট একটা অসংগঠিত খাত, দালালদের রমরমা খুব, মালিকের সঙ্গে চুক্তি-সামাজিক বীমা কিংবা পেনশনের কোনো বালাই নেই।”
“তামিলনাডুতে গত বছর গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বেড়েছে, তাও বারো বছর পর। গ্রামের গরিব মেয়েরা এই পেশায় আসে, ম্যানেজমেন্ট তাদের হোস্টেলে রেখে কার্যত বন্ডেড লেবারারদের মতো আচরণ করে। ব্যাঙ্গালোরে গত বছর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন নারী শ্রমিক যৌন নির্যাতনেরও শিকার।”
ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এ সপ্তাহে তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনগুলো ‘ইভাঙ্কা ট্রাম্প ব্র্যান্ডে’র কাছে এই সব প্রশ্নেরই জবাবদিহি চেয়েছিল – তারা সেটি শুধু উপেক্ষাই করেননি, এমন কী কোন কোন নির্মাতা সংস্থা ইভাঙ্কার ফ্যাশন লাইন সরবরাহ করেন সেটাও জানাতে অস্বীকার করেছেন।
ভারতে বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন সিটুর নেতা ও এমপি তপন সেনও বলছিলেন মার্কিন ক্রেতা সংস্থাগুলো ভারতে গারমেন্ট শ্রমিকদের সুরক্ষার সঙ্গে আপস করেন এই অভিযোগ অনেক পুরনো।
তপন সেনের কথায়, “প্রধান সমস্যাটা কোথায় জানেন, ক্রেতা সংস্থাগুলো পরিদর্শনের নামে আসে ঠিকই, কিন্তু তাদের ‘ম্যানেজ’ করে নেয়া হয়। এই ম্যানেজ করাটা হয় পোশাকের দাম আরও কমিয়ে – এবং শ্রমিক অধিকারের সঙ্গে আপস করে। মানে মার্কিন ক্রেতারা এসে বলেন শ্রমিকদের এই শোষণ নিয়ে আমরা চুপ করে থাকব, কিন্তু তার বদলে জামাকাপড়ের দাম আরো কমাতে হবে!”
দিল্লির আশেপাশে নয়ডা বা গুরগাঁও, তামিলনাড়ু, কর্নাটক বা বিশাখাপতনম – যেখানেই বেশি সংখ্যায় গারমেন্ট কারখানা আছে, সেখানেই মোটামুটি একই চিত্র বলে সেন জানাচ্ছেন।
“তবে তার মধ্যেই কর্নাটক বা বিশাখাপতনমে অন্তত শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারটুকু বজায় আছে – কারণ ওই দুটো জায়গায় শ্রমিক আন্দোলনেরও একটা পরম্পরা আছে।”
“তবু সাধারণভাবে আমরা বলি, নাইকি-র এক জোড়া জুতা আমেরিকায় যে দামে বিক্রি হয়- ভারতে যে শ্রমিক সেই জুতাটা বানাচ্ছেন তার গোটা মাসের মাইনে সেই দামের চেয়েও কম”, বিবিসিকে বলছিলেন তপন সেন।
এথিক্যাল ট্রেড ইনিশিয়েটিভের মার্টিন বাটলও জানাচ্ছেন, ইভাঙ্কা ট্রাম্প যে ধরনের আলট্রা হাই-এন্ড বা অত্যন্ত দামী ফ্যাশন সামগ্রী ব্যবহার করেন ভারতে তার নির্মাতা সংস্থাগুলোতেও শোষণের ছবিটা প্রায় একই রকম।
তার কথায়, “ভারতে এমব্রয়ডারি ও ওই ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিকদের খুব কম পয়সায় কাজে লাগানো যায় বলে হাই-এন্ড প্রোডাক্টের নির্মাতাদের কাছে ভারতের কদর খুব।”
“কিন্তু এই কাজগুলো সাধারণত সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে মূল সংস্থা আড়ালে থাকে, আর দালালদের আড়ালে শোষণ চলতে থাকে যে-কে-সেই,” বলেন তপন সেন।
আর এই কারণেই অনেকে মনে করছেন ইভাঙ্কা ট্রাম্প সত্যিই যদি ভারতে নারী শ্রমিকদের ভালো চান তাহলে তিনি মুখে যেটা বলছেন, আগে নিজে সেটা কাজে করে দেখান।