লন্ডনের বৈশাখি মেলা, জন বিগস এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের আরো কার্যকর ভুমিকা নেয়া উচিত, আমার নামটি মেলা কমিটি থেকে বাদ দেন প্লিজ
রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী।। মেলা সংস্কৃতি লন্ডনের বাঙালী কমিউনিটিতে কিভাবে শুরু হয়েছিল আমার জানা নেই। তবে দেশ বিকাশের বাংলাদেশ মেলা যখন ১৯৯১ সালে পূর্ব লন্ডনের ডেভেনান্ট সেন্টারে শুরু হয়েছিল, তখন দেশ বিকাশের সভাপতি মোনায়েম মায়েনিন বলেছিলেন, আমরাই শুরু করলাম মেলা সংস্কৃতি। পাশে বসা ছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক উপপ্রধান বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম সিরাজুর রহমান সাহেব, তিনি সেদিন মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন, আমি সিরাজ ভাইর পাশে বসা ছিলাম, সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞাস করেছিলাম আপনি কি দ্বিমত পোষন করেন? তিনি বলেছিলেন হ্যাঁ। পরবর্তীতে একদিন আমি একুশে গানের রচিয়তা আব্দুল গাফফার চৌধুরী সাহেবকে জিজ্ঞাস করেছিলাম সিরাজ ভাই তো দ্বিমত পোষণ করেছেন মেলা সংস্কৃতি নিয়ে, আপনি তো লন্ডনে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করছেন কে প্রথম শুরু করেছে মেলা সংস্কৃতি? গাফফার ভাই যেহেতু সিরাজ ভাইকে পছন্দ করতেন না, সেহেতু তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, জামদানী মেলা একটা করেছিল সেই কবে কখন এটা নিয়েই কথা বলছে। আমি পরে সে কথাটি সিরাজ ভাইকে বলেছিলাম যে আপনারা নাকি ছোট করে একটি জামদানী মেলা করেছিলেন , সিরাজ ভাই আমাকে পাল্টা জিজ্ঞাস করেছিলেন, তোমাকে কে বলেছে ? আমি বলেছিলাম, গাফফার ভাই বলেছেন। সিরাজ ভাই সেদিন বলেছিলেন, তাই নাকি? তিনি একুশের গান ছাড়া এ যাবত কি করেছেন একবার জিজ্ঞাস করো। আমার এ দঃসাহস নেই গাফফার ভাইকে এ কথা জিজ্ঞাস করার, তবে সিরাজ ভাইকে সেদিন বলেছিলাম গাফফার ভাই তো গান লিখেই জীবন্ত কিংম্বদন্তী। সিরাজ ভাই ছিলেন নিরুত্তর।
প্রিয় পাঠক, লন্ডনে দেশ বিকাশের বাংলাদেশ মেলা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ ইংরেজীর আগষ্ট মাসে। মোনায়েম সভাপতি ছিলেন, আমি ছিলাম সাধারন সম্পাদক, পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী ছিলেন অর্থ সম্পাদক, বর্তমান আওয়ামীলীগ নেতা খসরুজ্জমান খসরু সাহেবও ছিলেন, ছিলেন মনোয়ার হোসেন বদরুদ্দোজা, জহির উদ্দিন, মুজিবুল হক মুজিব, আব্দুল হান্নান, হুমায়ুন কবীর তুহিন, লিপি চুন্নু , শাফি চৌধুরী , ছিলেন ফাতেমা হোসেন পলি সহ আরো অনেকেই।
সে যাক, পহেলা জুলাই ২০১৮ লন্ডনে ইউরোপের সর্ববৃহৎ বাংলাদেশী মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্মৃতি যদি আমার সাথে প্রতারনা না করে তাহলে খুব সম্ভবত ১৯৯৭/৯৮ ইংরেজীতে যাত্রা শুরু হয়েছিল বৈশাখি মেলার, যিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি সুদর্শন স্মার্ট ব্যাক্তিত্ব, পেশায় একাউন্টেন্ট, দেশ টিভি ইউকের সাবেক এমডি, আমার অত্যন্ত প্রিয় ভাজন অগ্রজ মাহমুদ এ রউফ। রউফ ভাইর অফিস পূর্ব লন্ডনের ৬৮ ব্রিকলেইনের দ্বিতীয় তলায় বৈশাখি মেলার প্রথম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সে মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন ছড়াকার দিলু নাসের, আনসার আহমদ উল্লাহ, উদীচীর গোলাম মোস্তফা, সাবেক আওয়ামলীগ নেতা শাহাব উদ্দিন চঞ্চল, আমি, সহ আরো দুএকজন। বেশী মানুষ ছিলেননা সে মিটিং এ। সেই মিটিং এ নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল বৈশাখি মেলা হবে ব্রিকলেইনে। এবং সেই থেকে যাত্রা। পরবর্তীতে মেলা কমিটির সভাপতি সম্পাদক হয়েছিলেন আমার বন্ধু আব্দুর রশিদ এবং সাবেক কাউন্সিলর সোনাহর আলী। সোনাহর আলী সাহেবকে দীর্ঘদিন দেখিনি। একবার শুনেছিলাম তিনি সৈয়দ আশরাফ সাহেবের সাথে আওয়ামীলীগ করছেন। ২০০৮ এর নির্বাচনের পরপরই একবার ঢাকায় দেখা হয়েছিল ওয়েস্টিন হোটেলের লবিতে, আমি তখন গিয়েছিলাম ঢাকায় নির্বাচন দেখতে। সোনাহর ভাই বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, এবং আশরাফ ভাইর তত্বাবধানে আছেন। শুনে ভালই লেগেছিল। কারণ আশরাফ সাহেবের সাথে সোনাহর ভাইর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল চমৎকার। আশরাফ ভাই যখন লন্ডনে থাকতেন তখন সোনাহর ভাইদের গ্রুপের সাথে উঠা বসা করতেন। এখন সোনাহর আলী সাহেব আবার লন্ডনে চলে এসেছেন। সোনাহর ভাইদের পর মেলা খুব সম্ভবত টেইকওভার করেছিলেন সিরাজ হক ও চ্যানেল এস এর প্রতিষ্টাতা মাহি ফেরদাউস জলিল। এর পর মেলা টেইকওভার করে টাওয়ার হ্যমলেটস কাউন্সিল।
সে যাক, মেলা বাঙালী সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অবশ্য দ্বিমত রয়েছে, মৌলানা সাহেবরা বলেন, মেলা হচ্ছে কুসংস্কার, নাফরমানী। মেলাতে মহিলারা যেভাবে পর পুরুষের সাথে ছবি তুলে ফেইসবুকে দিয়ে দেন এটাকেই মৌলানা সাহেবরা বলেন নাফরমানী। যুক্তি আছে মৌলানা সাহেবদেরও। তারপর তো রয়েছে পেট দেখানো, পা দেখানো, বুক দেখানো আরো অনেক কিছু———। একটি মেলায় যে শুধু গান বাজনা আর নাফরমানী হবে তা কিন্তু না। অনেকেই বলেন বৈশাখী মেলায় গান বাজনা ছাড়া আর কি আছে? কথাটি অনেকাংশেই সত্য। মেলাকে ঢেলে সাজানো দরকার। এবারের মেলা এংগেজমেন্ট কমিটি থেকে আমার নাম বাদ দেয়া হয়েছে আবার যোগ করা হয়েছে। এক কাউন্সিলর বলেছেন আমি নাকি কোনো মিটিং এ যাইনা, কথাটি সত্য। মিটিং এ গিয়ে আমি কি করবো? মেলা এংগেইজমেন্ট গ্রুপ যেটি এটি তো একটি অকার্যকর গ্রুপ। আমার কি সে সময় রয়েছে এ গ্রুপের মিটিং এ গিয়ে ফালতু কথা শুনার? মেলায় কি হবে না হবে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে আসলেন কাউন্সিলের কোনো কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তার যোগ্যতা কি? আমাকে মেলা কিভাবে করতে হয় তা তো শিখিয়ে লাভ নেই। বৈশাখি মেলা হবে। আমি যদি কমিটিতে থাকি আমার মতামত নিতে হবে। আর যদি মতামতের তোয়াক্কা না করেন তাহলে কাউন্সিলর সাহেবরা করেন, সুন্দর এবং অবিতর্কিত ভাবে করেন। মুখ দেখে দেখে গানের শিল্পী সিলেক্ট করবেন কেন? মানুষ তো অনেক কিছুই বলে, অনেকেই অভিযোগ করে, আমরা মিডিয়ায় সেটি বলিনা। আমি বিশ্বাস করি এবং মনে প্রাণে চাই মেলা কাউন্সিল করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কমিউনিটির কারো কাছে মেলার দায়িত্ব অর্পিত হলে তা নিয়ে মারামারি হবে, কথা কাটাকাটি হবে, লেখালেখি হবে, প্রেস কনফারেন্স হবে, ঝামেলা বাড়বে অনেক, আমি ব্যাক্তিগতভাবে সেটি কখনো চাইনা।
লন্ডনে নটিংহাম কার্নিবালের পর বৈশাখি মেলায়ই বেশী লোকসমাগম হয়। এটিকে আরো ঢেলে সাজানো দরকার। আমি সবিনয়ে বলি মেলা এংগেইজমেন্ট কমিটি থেকে আমাকে বাদ দিন প্লিজ। আমাকে বাদ দিয়ে আরো অভিজ্ঞ যারা রয়েছেন তাদেরকে নিন, আমি চার বছর ছিলাম। নতুন নিয়োগ দেয়া দরকার। মাহমুদ এ রউফ ভাই এখনো জীবিত তিনি প্রতিষ্টাতা, তাকে নিন, সোনাহর আলীকে নেয়া দরকার, পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরীকে নেয়া দরকার, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি সৈয়দ নাহাশ পাশাকে অর্ন্তভুক্ত করা দরকার, ক্যাটারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সম্পাদক, চ্যানেল এস, এটিএন, এনটিভি, বেতার বাংলার নাজিম চৌধুরী, সহ কমিউনিটির অনেকেরই মতামতের দরকার রয়েছে। বৈশাখি মেলায় বৃটিশ বাঙালীদের সংস্কৃতিক কর্মকান্ড উঠে আসা দরকার। মেলা উপলক্ষে একটি সুভ্যেনির প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে কোনো কিছুতেই বাংলা একটি শব্ধ নেই। এসব বিষয়গুলো কে দেখবে? বাংলাদেশের পর বৃহৎ একটি মেলা লন্ডনের মত জায়গায় গড়ে উঠেছে এটিকে ধরে রাখতে হবে। ক্ষুদ্র স্বার্থকে পিছনে ফেলে বৃহৎ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। লন্ডনের বৈশাখি মেলার গল্পকে অনেকেই একদিন রুপকথার গল্পের সাথে হয়তো তুলনা করবেন। কারণ বাংলাদেশের বাইরে এত বড় মেলা আর কোথাও হয়নি, হবেওনা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন গল্প করতে পারে যে, তাদের পূর্ব পুরুষরা বাংলাদেশের বাইরে বঙ্গপোসাগর অতিক্রম করে আটলান্টিকের পাড়ে লন্ডনের নক্ষত্রের কোল ঘেঁষে থাকা অন্য এক বাংলা সৃষ্টি করে সেখানে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করেছে। যেখানে মানুষ ছুটে বেড়ায় পিপীলিকার মত, যেখানে মানুষের দম ফেলানোর মত সময় নেই। সেই জায়গায় আমরা সৃষ্টি করেছি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা মিলন কেন্দ্র।
প্রিয় পাঠক, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, যেখানে ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড রয়েছে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করে বৃটিশরা ভারত উপমহাদেশে ব্যবসা বানিজ্য করেছিল, সেখানেই আমরা নোঙর করেছি। টেমসের পাড় থেকে যে ছোট খালটি অফ হয়েছে ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড হয়ে ডকল্যন্ডের বিভিন্ন জায়গায় আপনারা দেখবেন জাহাজের বড় নোঙর করার কালো চেইন, সে সবই কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। এক সময় যে খালটি মৃত হয়ে বসেছিল সে খালটিই এখন জেগে উঠেছে বৃটিশ বাঙালীদের পদচারণায়, ইষ্ট ইন্ডিয়া ডক রোড থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দুরে গড়ে উঠেছে বৈশাখি মেলা, যে মেলায় চাঁদনী ফেলে অসংখ্য বাঙালী নারী পুরুষ, এ যেন তাদের পূর্ব পুরুষের রক্তের ঋণ শোধিত হচ্ছে। এ যেন বছরের একটি দিন বহুকালের পথ এসে মিশে যায় উইভারর্স ফিল্ড ব্রিকলেইন তথা ভ্যালেন্স রোডের ছায়াতলে। আমি অভিমান করে মেলায় না গেলেও মানুষের কোলাহল আমি নীরবে নিভৃতে প্রত্যক্ষ করি, আমি প্রত্যক্ষ করতে চাই অনন্তকাল ধরে। এসব চিন্তার মধ্যেই আমি আমার লেখা শেষ করার সময় মনে পড়ে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগসের পলিটিক্যল এডভাইসার সৈয়দ মনসুর উদ্দিনের কথা, তিনি এবারের মেলার পর বলেছিলেন একজন ফয়সল চৌধুরী মেলায় না গেলেও মেলা হিউজ সাকসেস হয়েছে। আমি মনের অজান্তেই গেয়ে উঠি ”যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,…..”
শেষ কথাঃ মেলা টাওয়ার হ্যমলেটস কাউন্সিলের তত্বাবধানে হলে ভালোই হয়। তবে সর্বময় ক্ষমতা যদি কাউন্সিলের আর্টস এন্ড কালচারের লিড মেম্বারের উপর দেয়া হয় তাহলে আমার মত একজন নিরীহ মানুষের নাম একবার সরাবে আবার যোগ করবে। আমার নাম সরানোক আমি কোনো বড় অপরাধ হিসেবে গন্য করিনা, তবে যেভাবে সরানো হয়েছিল আমি সেটার প্রতিবাদ করেছি মাত্র। আর যিনি সরাবেন আমার নাম তিনি কোন যোগ্যতার বলে সেটি করলেন তা ও আমার জানতে ইচ্ছে করেছিল, আমি জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু মনসুর উদ্দিনের কারনে অনেক কিছুই জানা হয়না। মনসুর ভাই কিছু হলেই বলবেন ফয়সল চৌধুরী শোয়েব ভাই বিষয়টি নিয়ে কথা না বললে হয়না। সে যাক, আরেকটি বিষয় লিখতে চাই, লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনকে মেলায় আরো বেশী অর্ন্তভুক্ত করলে মেলা সুন্দর হবে, প্রাণবন্ত হবে। হাইকমিশন ইনবলভ হওয়ার মানে হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ইনবলভ হওয়া। বিষয়টি মেয়র জন বিগস ভেবে দেখবেন আশা করি।
লেখক: সভাপতি ইউকে বাংলা প্রেস ক্লাব,সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি বাংলা স্টেটমেন্ট ডট কম,ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যানেল আই ইউরোপ।
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)