গল্পের সংজ্ঞা বদলে দে’য়া আধুনিক মানুষ
জান্নাতুল চৌধুরী তামান্না: আমরা আধুনিক মানুষ একে অন্যের কাছে হয়ে উঠেছি জটিল, সাংঘাতিক অস্পষ্ট, সংশয়ী, তবে কেন? আজকাল শহীদের গল্পের সংজ্ঞা ও বদলে গিয়ে নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে একুশের। আমরা মাতৃভাষা পেয়েছি, আমরা বাংলায় লিখতে শিখেছি, কিন্তু আমরা ক’জনইবা পারি নিজের মনের কথা তুলে ধরতে, এসব নতুন নতুন গল্প বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ করতে। ওরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল বায়ান্নতে, ২৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ও ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন এ-ভূখ-ের জনজীবনকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। একুশের অভিঘাত ও রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের গল্পকারদের সবচেয়ে বেশি জীবনমুখী করেছে, মানবিক বোধে উজ্জীবিত করেছে। কিন্তু সে গল্পকেও তারা বদলে দিতে চায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁরা লিখেছেন রক্ত ও অশ্রুপাতের গল্প। যুগের বেদনা ও যন্ত্রণাকে ধারণ করেছে একুশের ছোটগল্প। আমরা বায়ান্নের গল্প লিখি, আমরা একাত্তরের গল্প শুনি, কিন্তু আমরা কি লিখতে পারবো ২০০০ এর গল্প, আমরা কি লিখতে পারবো যারা ২১ এবং একাত্তরের গল্পকে বদলে দিতে চাচ্ছে তাদের কথা ! তাহলে ভাষা আমরা পেলাম-কিন্তু স্বাধীনতা পেলাম না, আমরা কি বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে ওরা, আজ আমাদের ধ্বংস করছে ! না পারবো না ??? চিৎকার করে যদি আমরা বাংলা কাঁদতে না পারি, একসাথে মিলেমিশে বাংলা হাসতে না পারি, আমরা সবাই মিলে যদি গাইতে না পারি, যদি স্বাধীন ভাবে একুশ কে শ্রদ্ধা করতে পারি না যদি বলতে না পারি –
” নব নবীনের গাহিয়া গান/সজীব করিব মহাশ্মশান/আমরা দানিব নতুন প্রাণ/বাহুতে নবীন বল/চল রে নও-জোয়ান/শোন রে পাতিয়া কান/মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে/জীবনের আহবান।/ভাঙ রে ভাঙ আগল/চল রে চল রে চল/চল চল চল “-
একুশের সাহিত্যিক শস্য ‘ছোটগল্পে’ আমাদের এই যুগের দাবি কতটুকু পূরণ করেছে ??? কার কাছে প্রশ্ন করি বলো, সবাইতো নিজ স্বার্থে ব্যস্ত !!! কীভাবে ধারণ করেছে আমাদের রক্তাক্ত বেদনাকে, শুধু সেটাই কি। তুলে ধরাই বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য। কল্লোলিত সমকালের অনেক অভিজ্ঞতার উত্তাপে দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী নির্মাণ ও নির্ণয় করেন ত্রৈকালিক বিভূতি। সমকালীন জীবনাবেগকে অঙ্গীকার করে তাঁর রচনা নবতর মাত্রায় স্পন্দিত হয়। সঞ্চার করে নবতর সংবেদনা। লক্ষণীয়, একুশের ছোটগল্পের অনেক গল্পকারও এই সংগ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শরিক হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁদের মনে। ফলে একুশের ছোটগল্পে তাঁদের হৃদয়াবেগ দেশমাতৃকার প্রেমে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রবাসেও। ভাষা-আন্দোলনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষর নিয়ে 1953 সালে প্রকাশিত হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন কিন্তু আমরা হাজার হাজার প্রবাসী, কোন সংকলন রেখে যাচ্ছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ?????
আজ আমরা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছি বায়ান্নের ভাষা শহীদদের মত আমাদের মাতৃভাষার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে রাখার জন্য !!! আজ 2020 দাঁড়িয়ে বিলেতের বুকে আমাদের শহরের ঐতিহ্যবাহী স্মলহিত পার্কে আমরা পেলাম আরো একটা শহীদ মিনার, যেখান থেকে আন্দোলন করেছিল আমাদের বাঙালিরা ১৯৭১ এ। তা’ইবা কম কিসের। ব্রিটিশ কারোকলামে বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই বা কম কিসের। তাদেরই আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা ছোট গল্প লিখছি, কবিতা লিখছি, নাই পারলাম মনের ভাব প্রকাশ করতে, লিখছি তো। বায়ান্নে ছিল পাকিস্তানি, একাত্তরে মিশে ছিলো আমাদের রক্তের সাথে হারামি !!! আজও রক্তে দংশন করে যাচ্ছে !!! ওরাতো বাংলা কথা বলে ! ওরাও ইতিহাস লিখে ।
আমরা কি পেরেছি এ শহরে একটা বাংলা স্কুল করতে, ইন্ডিয়ানরা তো তাদের নিষ্কাম স্কুল বানিয়েছে, আমরা কি আমাদের বাচ্চাদের ছোট গল্প সাহিত্য এগুলা শিখাতে পেরেছি !!! মাঝেমধ্যে মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে যদি আমরা বাংলাদেশী নিয়ে যাই, ওরা হাঁটতে পারবে না, একটা দোকানের নাম পড়তে পারবেনা কাপড় বদলানোর জন্য, একটা ঠিকানা পেলে সেখানে কি পৌঁছাতে পারবে না, সাহিত্য চর্চা, ছোট গল্প গুলোর শুধু রয়ে গেল আমাদের প্রজন্মে, এরপর আমাদের মাতৃভাষা আমাদের থেকে বিলুপ্ত ! তবুও আমরা চেষ্টা করি বাংলা ধরে রাখতে, আমি কবিতা লিখি, হা হা হা, আমি বাংলায় কবিতা লিখি..
“বেচারা কবিতা আজ বাঁকা হয়ে গিয়েছে,
সেই কবে থেকে গেঁড়ে বসে আছে
ঐ ভারী ভারী শব্দগুলো, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
সিন্দাবাদের ভুতের মত, যুগান্তরে পুঞ্জীভূত বোঁঝা যত!
আহ, একটুও কী নিস্তার নেই ? হতচ্ছাড়া শব্দগুলো মাড়িয়ে আমি কবিতা লিখি
মাগো, তুমি বেশ আছো, নেশাসক্ত ঘুম নিয়ে
দেখছ না তোমার বীর সন্তানের বংশধর আজ নিবীর্য
দম দেয়া ঠোটের আগায় নিরন্তর ‘রেডিওতে জগাখিচুড়ী’ !