টিউলিপ সিদ্দিকীকে নিয়ে আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন এবং লন্ডনে বাঙালীদের বৃটিশ রাজনীতি
রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী।। ৭০ দশকের শেষের দিকে বর্ণবাদী আন্দোলনে লন্ডনে আলতাব আলী শহীদ হওয়ার পর বাঙালীরা বুঝতে পারে বৃটিশ রাজনীতিতে বাঙালীদের অংশগ্রহন করতেই হবে। সেই থেকে পথ চলা। তৎকালীন সময়ে পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন ও বো আসনে এমপি ছিলেন মরহুম পিটার শোর, ১৯৭১ সালে পিটার শোর বলেছিলেন,“ একটি দেশের স্বাধীনতার মুল্য যদি রক্ত হয়ে থাকে, তাহলে বাঙালীরা সে রক্ত অনেক আগেই দিয়ে ফেলেছে“। সেই থেকেই পিঠার শোর কে বৃটিশ বাঙালীরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু পিটার শোর ও বাঙালীদের সাথে কম করেননি। তিনি যখন অবসর নেন তখন কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি কোনো এক বাঙালীকে মনোয়ন দিতে পারতেন তার আসনে। কিন্তু সে সময়ে লেবার পার্টি থেকে মনোয়ন লাভ করেছিলেন উনা কিং। আমি সে ইতিহাস নিয়ে লিখতে চাইনা। উনা কিং এর সাথে তৎকালীন সময়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দি¦তা করেছিলেন কনজারভেটিব পার্টি থেকে ডঃ কবীর চৌধুরী, সেটি খুব সম্ভবত ১৯৯৭ ইংরেজী কথা। জনাব চৌধুরীকে তখন বাঙালীরা ভোট দেয়নি। সেই নির্বাচনে উনা কিং জয়লাভ করেছিলেন, পরবর্তীতে কবীর চৌধুরী হাউস অব লর্ডসের মেম্বার হওয়ার কথা থাকলেও স্বরস্বতীও লক্ষী এক জায়গায় বসবাস করতে পারেনি বলে তিনি হাউস অব লর্ডসের মেম্বার হতে পারলেননা। শুনেছি কবীর চৌধুরী এক সময় নটরডেম কলেজের লেকচারার ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি লন্ডনে ছিলেন, বর্তমানে সিলেটে বসবাস করছেন
।
সে যাক, ১৯৯৭ ইংরেজীর পর উনা কিং দু টার্ম এমপি ছিলেন তারপর ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর উনা কিং ইরাক যুদ্ধকে সমর্থন করলে বেথনালগ্রীন বো আসনে জর্জ গ্যালাওয়ে মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে আবির্ভুত হন। বেথনালগ্রীন ও বো আসনের ভোটাররা তখন গ্যালওয়াকে নির্বাচিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে লেবার পার্টি সিট পুনরুদ্ধারের জন্য শর্টলিষ্টে কোনো বাঙালী রাখেনি, যার কারনে মনোয়ন লাভ করেন রুশনারা আলী । সেই থেকেই রুশনারা আলী এমপি হন।
প্রিয় পাঠক, বৃটেনের মেইনষ্ট্রিম রাজনীতিতে বৃটিশ বাংলাদেশী যে কজন তারাকা রাজনীতিবিদ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছন তার মধ্যে টিউলিপ অন্যতম। টিউলিপকে লেবার পার্টির রাজনীতিতে কে উৎসাহিত করেছিলেন আমি সঠিক করে বলতে পারবোনা, তবে শুনেছি তৎকালীন সময়ে ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিনই ছিলেন লেবার পার্টির বাঙালীদের ভরসা। পলা আপার সাথে টিউলিপের মা শেখ রেহানা আপার সম্পর্ক ছিল ভালো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথেও সম্পর্ক ছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় পলা উদ্দিনই হাউস অব লর্ডসে বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে মিটিং এর আয়োজন করতেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারন নির্বাচনের সময় ব্যারোনেস পলা উদ্দিন, ডাক্তার আনোয়ারা আলী, ব্যারোনেস সেন্ডী বার্মা ঢাকায় গিয়েছিলেন, তখন আমিও গিয়েছিলাম তাদের সাথে। তারা ছিলেন বৃটিশ অবজারভার, নির্বাচনের পরের দিন আওয়ামীলীগ সভানেত্রীর বাসায় গিয়েছিলেন বৃটিশ অবজারভার দল, আমাকে বলেছিলেন যাওয়ার জন্য আমি যাইনি, কারন স্ত্রীর পিছনে পিছনে যাওয়াটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হতো, এখনো মনে হয় । ঢাকায় তখন বৃটিশ হাইকমিশনার ছিলেন ষ্টিফেন ইভান্স। ষ্টিপেন ইভান্স বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার বাসায়ও গিয়েছিলেন, রাতে ষ্টিপনে ইভান্সের বাসায় ডিনার পার্টি ছিল,কথা প্রসংঙ্গে জিজ্ঞাস করেছিলাম ইভান্সকে নেত্রীদের মধ্যে কাকে তোমার ভালো লেগেছে? ষ্টিপেন বলেছিলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আপ্যায়ণ করেছেন , রেহানা আপারও প্রশংসা করেছিলেন, রেহানা আপার মেয়ে টিউলিপ বৃটিশ রাজনীতির প্রতি ইন্টারেষ্টেড সে সব কথাও আলোচনা হয়েছিল সেদিন। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন উনি নির্বাচনে হেরে গিয়ে হয়তো মন খারাপ করেছেন। বুঝলাম খালেদা জিয়া খুব একটা কথা বলেননি। না বলাটা স্বাভাবিক, তবে কুঠনৈতিকদের সাথে ভালো ব্যবহার করা উচিৎ। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর গত কয়েক বছরে পলা আপার সাথে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কাউকে দেখা যায়নি, অনেক দিন থেকে পলা আপাকে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তার সর্ম্পকের কথা জিজ্ঞাস করতে যেয়ে ভূলে যাই, তবে সম্পর্ক খুব একটা যে ভালো নেই তা আমি বুঝি। কারন মানুষ গরীব হলে মায়া বাড়ে। ক্ষমতায় না থাকলেও মায়া বাড়ে। ক্ষমতায় থাকলে দুরত্ব সৃষ্টি হয়! কেন হয় তা অনেকেই বলতে পারেন। তবে পলা আপার সাথে তো আওয়ামীলীগ সরকারের কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নেই।
সে যাক, প্রিয় পাঠক টিউলিপকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়া। ২০০৭ এর দিকে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। ডাক্তার আনোয়ারা আলী। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যমলেটসের কাউন্সিলর ছিল, ছিল কেবিনেট মেম্বার। আমাকে বৃটেনের হাউস অব পার্লামেন্ট দেখিয়ে একদিন বলেছিল এখানে আমি প্রবেশ করতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে। করেছি, স্ত্রী হিসেবে যতটুকু করার । রান্না বান্না নেই ঘরে, ভাত খেতে পারিনা, মেকডনাল্ড আর কেএফসি খেয়ে দিন কেটেছে। আমার মা আমাদের বিয়ের সময় বলেছিলেন ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করছিস আল্লাহ জানে তোর পেটে দানা পানি পড়বে কি-না? সে যাক আনোয়ারা আলী বৃটিশ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু চুড়ান্ত সফলতা আসলোনা, আনোয়ারা আলীর জায়গায় চলে আসলেন রুশনারা আলী। আনোয়ারা আলীর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। তারপর রুশনারা আলীর পথ চলা, কিন্তু সে পথ চলা মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা, ছিল কন্টকাকীর্ন। রুশ হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে গেলেন। মোটামুটি তিনি হাউস অব পার্লামেন্টে এমপি হিসেবে খুব একটা সুনাম বয়ে না আনলেও দুর্নাম বয়ে আনেননি কমিউনিটির জন্য। এরই মধ্যে যোগ দিলেন ডঃ রুপা হক এবং টিউলিপ সিদ্দিকী। আমি অন্য রকম এক স্বপ্নে বিভোর হলাম। কিছুদিন আগে বৃটিশ এক রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, এমন এক দিন আসবে বৃটিশ বাংলাদেশী যে কেউ বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে। আমার কাছে তার কথাটি হাস্যকর এবং পলিটিক্যাল ব্লাফ মনে হলেও টিউলিপ এমপি হওয়ার পর সেটি আর হাস্যকর মনে হয়নি। কারন টিউলিপের বয়স, কথা বার্তার ষ্টাইল আমার কাছে মনে হয়েছে সময়ের বিবর্তনে টিউলিপ অনেক এগিয়ে যাবেন। এমন ও তো হতে পারে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী মাইকেল হেসলটাইন তার ছাত্র জীবনে শিক্ষককে বলেছিলেন আই উয়িল বি প্রাইম মিনিষ্টার ইন দিস কান্ট্রি। কিন্তু হেসেলটাইন তার স্বপ্নের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন হেসলটাইন, কথা
ছিল তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, হলোনা, চলে আসেন জন মেজের।সে যাক আমি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম টিউলিপ একদিন প্রধানমন্ত্রী হবেন বৃটেনের।
আমি এর আগে ২০১৫ সালের জুন মাসে আমাদের সময় ডট কমে লিখেছিলাম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এড্রেস করে “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিউলিপকে প্রস্ফুটিত হতে দিন ধান্দাবাজদের সামলান“ । টিউলিপ কতটুুকু প্রস্ফুটিত হয়েছেন আমি জানিনা, তবে সপ্তাহ খানেক আগে চ্যানেল ফোর এ টিউলিপের সাক্ষাতকার দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এ কি বলছেন টিউলিপ? চ্যানেল ফোর এর এলেক্স টমসন বৃটেনে বেশ ক জন হাতে গোনা সাংবাদিকের মধ্যে অন্যতম। টমসনকে টিউলিপ অন্যভাবে উত্তর দিতে পারতেন। আমার স্বপ্ন অনেকটা ভেঙ্গে যায়, স্বপ্ন হোচট খায়, অনেকের স্বপ্ন যে রকম স্বপ্ন থেকে যায় আমারও স্বপ্ন কি সে রকম হবে? চ্যানেল ফোর এ টিউলিপের সাক্ষাতকার প্রচার হওয়ার পর টিউলিপ বিরোধীরা অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে। লন্ডনে আরেক সমস্যা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি, চেতনার সমস্যা, আর রাজাকারদের সমস্যা। চেতনার সমস্যার বিরুদ্ধে যদি আপনি কথা বলেন তাহলে আপনি হবেন রাজাকার, আর রাজাকারদের বিরুদ্ধে কথা বললে আপনি হবেন মুক্তিযুেদ্ধর চেতনা ব্যবসায়ী। সে যাক স্বপ্ন নিয়ে নাকি মানুষ বেঁচে থাকে। স্বপ্ন মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু স্বপ্ন তো এক সময় হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় প্রচন্ড ভালোবাসা। যে স্বপ্ন এক সময় আকাশ ছোঁয়া হয় সেই স্বপ্ন যখন হারিয়ে যায় তখন গভীর রাতে মানুষ বসে বসে কাঁদে।
প্রিয় পাঠক, আমি স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। টিউলিপ, রুপা হক, রুশরা বৃটিশ রাজনীতিতে ভালো করবে। তাদেরকে শিখতে হবে কিভাবে বৃটিশ সাংবাদিকদের ফেইস করতে হয়। আপনি যদি রেগে যান তাহলে তো হেরে যাবেন। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, আর অভিমানের জায়গা এ পৃথিবীতে নেই। টিউলিপকে সাংবাদিক ফেইস করা জানতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক সময় বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ধমক দেন, টিউলিপ সেটিকে ফলো করতে গেলে সমস্যা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন জোঁক করে বলেন “বিএনপিকে বরনঢালা দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসবেন নাকি?“ সেটিকে গ্রহন করতে পারেন। হেসে খেলে উড়িয়ে দিতে হবে। সিরিয়াস প্রশ্ন যখন আসে তখন এক কথায় উত্তর দিয়ে দিতে হবে। তবে টিউলিপ ঘটনার পরের দিন এপলজি দিয়েছেন। এটি ভালো লক্ষণ। ভূল হলে মাফ চাইতে হবে, এটি বৃটিশরা পছন্দ করে। আমার বিশ^াস টিউলিপের এপলজি চ্যানেল ফোর গ্রহন করেছে। কারন আমি চাইনা টিউলিপের সামাান্য ভূলের কারনে আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন অংকুরেই বিনিষ্ট হোক।
শেষ কথাঃ টিউলিপ বিরোধী যারা তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ লন্ডনে যারা বৃিটশ মেইনষ্ট্র্রিম রাজনীতি করেন তাদেরকে দলমত নির্বিশেষে সমর্থন করতে হবে। এবং বা ঙালী যারা বৃটিশ এমপি তাদের প্রতিও আমার বিনীত অনুরোধ যে কেউ ইমেইল করলে তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবেন। ফোন করলে উত্তর দিবেন। আমাদের কাছে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে অনেক এমপিকে ফোন করলে ইমেইল করলে তারা উত্তর দেননা।আমি নিজেও এটির ভূক্ত ভোগী। তবে ইংলিশ কোনো এমপিকে ইমেইল অথবা ফোন করলে সাথে সাথে উত্তর দেন। সেদিন আমি আমার অফিসের সামনে গাড়িতে উঠছি সেই সময় পপলা ও কেনিং টাউনের এমপি জিম ফিজ প্যাট্রিক হেটে যাচ্ছেন সাথে তার স্ত্রী শিলা, আমি খেয়াল করিনি। জিম ঠিকই আমাকে খেয়াল করেছেন, আমাকে বলেছেন হ্যালো ফয়সল? আমি তাকে না দেখে সিলেটি ভাষায় জোক করে বলেছি “কে বা“ মানি কে তুমি, জিম সিলেটি ভাষায় বলেছেন আমি জিম-বা। এর আগে আমি একদিন জিমকে ফোন করে ভয়েস মেইলে ম্যাসেজ রেখেছি জিম হাউস অব পার্লামেন্টে ছিলেন তিনি বের হয়েই আমাকে ফোন আনসার করেছেন। এই হচ্ছেন জিম ফিজ প্যাট্রিক। আর বাঙালী যারা এমপি………………। অনেকের নাকি অহংকার চলে এসেছে। অহংকার আল্লাহ পছন্দ করেননা। অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। তাই সবার প্রতি অনুরোধ রাখতে চাই- সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে সহজভাবে মিশো চেতনার স্তর যত নিচেই থাকনা কেন সময়ের বিবর্তনে সে অনেক উপরে উঠে যাবে তুমি অনেক নিচে পড়ে থাকবে।
লেখক : সভাপতি ইউকে বাংলা প্রেস ক্লাব,
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি বাংলা স্টেটমেন্ট ডট কম,
ব্যবস্থাপনা পরিচালক চ্যানেল আই ইউরোপ।
(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন)